ঢাকা   বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Image Not Found!

সর্বশেষ সংবাদ

  আ.লীগ সমর্থককে জোর করে লিফলেট দিচ্ছে বিএনপি নেতারা (রাজনীতি)        স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে নাহিয়ানের, ফেব্রুয়ারিতে উৎক্ষেপণ হবে রকেট (বাংলাদেশ)        নির্বাচন আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ: ওবায়দুল কাদের (জাতীয়)        ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সবাই আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছে:রিজভী (জাতীয়)        আপিলে এ পর্যন্ত প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন ১৬৮ জন (জাতীয়)        প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গণভবনে রওশন এরশাদ (জাতীয়)        মেজর হাফিজকে বিদেশ যেতে দেয়নি সরকার (জাতীয়)        ভয়ংকর টর্নেডোয় তছনছ টেনেসি, নিহত কমপক্ষে ৬ (জাতীয়)        ২০০৯ সালের পরে শেখ হাসিনা নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করেছেন : ওবায়দুল কাদের (জাতীয়)        অবরোধের সমর্থনে গুলশানে শ্রাবণের নেতৃত্বে মশাল মিছিল (জাতীয়)      

ঢাকায় রান্নায় ভোগান্তি

Logo Missing
প্রকাশিত: 07:13:58 am, 2023-10-24 |  দেখা হয়েছে: 2 বার।

বাজারে বেগুন ১২০ টাকা, কচুর মুখি ১০০ টাকা, পটল ১০০ টাকা, মিষ্টি কুমড়োর ফালা (এক কেজি) ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর্থিক সংকটের কারণে একটু নি¤œমানের বেগুন ১০০, কচুর মুখি ৮০, পটল ৮০ এবং কুমড়া ৫০ টাকা কেজি দরে কিনেছেন মো. ফজলু। মোছা. আনোয়ারার স্বামী ফজলু রাত ৯টায় অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে শনির আখড়া বাজার থেকে সবজি কিনে এনেছেন।

আনোয়ারা আগের রাতের ভাত রাইস কুকারে গরম করে খেয়ে তরি-তরকারি কেটে রেখেছেন রাতে গ্যাস এলে রান্না করবেন। অপেক্ষা করছেন রাতে গ্যাস এলে চুলা জ্বালাবেন পরের দিন দুপুরের খাবারের জন্য তরকারি রান্না করবেন। আগের রাতে সাড়ে ১১টার সময় চুলায় গ্যাস এসেছিল তাই রাত ১১টা থেকে অপেক্ষা তার। ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে রাত গভীর হয়ে যায়। কয়েক মিনিট পর পর রঁসুই ঘরে গিয়ে চুলার চাবি ঘুরাচ্ছেন, গ্যাস আসছে না। আনোয়ারার রান্নার অপেক্ষা শেষ হয় না। রাত আড়াইটায় চুলার চাবি ঘুরাতেই শোঁ শোঁ শব্দ করে একটু বাতাস আসছে, ভাবলেন হয়তো এখনই গ্যাস আসবে। আবার অপেক্ষা। এভাবে ১০ মিনিট বাতাস আসার পর অবশেষে চুলায় মিটি মিটি গ্যাস এলো। রান্নার জন্য কেটে রাখা সবজির দিকে হাত বাড়ালেন। হায় আল্লাহ! সব সবজি পচে গন্ধ বের হচ্ছে। পচে যাওয়া সবজি ফেলে দিয়ে অগত্যা নিভু নিভু আগুনের চুলায় ভাত উঠিয়ে দিয়ে তরকারির ব্যবস্থা কি করবেন তা নিয়ে চিন্তা করতে থাকেন। এটা কোনো সিনেমা-নাটকের গল্প নয়, বাস্তব চিত্র। প্রতিদিন রাজধানী ঢাকার হাজার হাজার পরিবারের জীবনকাহিনী। দিনে গ্যাস আসে না। রান্নার গ্যাসের জন্য বিনিদ্রিত রাত কাটাচ্ছেন গৃহিণীরা। রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় লাখ লাখ রঁসুই ঘরে একই দৃশ্য। আর্থিক সংকটে হোটেল থেকে খাবার কিনে খাওয়ার সমর্থ নেই।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গভীর রাতে বড় বড় বিল্ডিংয়ের দিকে তাকালে দেখা যায় শেষ রাতে অধিকাংশ ফ্ল্যাটে বাতি জ্বলছে। রমজান মাসের সেহরির রান্নার মতো মহিলারা শেষ রাতে রান্না করছেন। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে পেরে উঠতে পারছেন না নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্তের নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ। পরিবারগুলোকে কম খেয়ে এবং গ্যাসের সংকটে নিদারুণ কষ্টের সময় পার করতে হচ্ছে। শুধু বাসাবাড়িতে গ্যাস সংকট নয়, গ্যাস সংকটে হুমকির মুখে শিল্প উৎপাদন। দীর্ঘদিন ধরে চলা গ্যাস সংকট শিল্প উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। দেশের প্রধান রফতানিমুখী শিল্প তৈরী পোশাকের কাঁচামাল সরবরাহকারী টেক্সটাইল খাতের স্পিনিং মিলের উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকই ব্যবহার করা যাচ্ছে না। সাভারের লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম জানান, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে কারখানার ইউনিট-২ বন্ধ করে দিয়েছেন। একই গ্রুপের মালিকানাধীন নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় অবস্থিত ইনটিমেট স্পিনিং মিল নামে একটি কারখানাও একই সমস্যার কারণে বন্ধ রয়েছে। বস্ত্রকল ছাড়াও গ্যাস ও বিদ্যুৎনির্ভর স্টিল, সিরামিক, সিমেন্টসহ অন্যান্য শিল্পও একইভাবে গ্যাস সংকটে ভুগছে এবং উৎপাদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। গ্যাসের অভাবে উৎপাদন কমে গেলে সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হবে আর সেটা হলে তা উন্নয়ন কাজেও বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ গার্মেন্টস মেনুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, সময়মতো উৎপাদন করতে ব্যর্থ হলে রফতানি করা যাবে না। ফলে বিদেশি ক্রেতারা ঝুঁকি কমানোর জন্য বাংলাদেশে ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিয়ে অন্য দেশে ক্রয়াদেশ বাড়িয়ে দেবেন। এতে গোটা শিল্প ঝুঁকিতে পড়বে আর বেকার হবেন লাখ লাখ শ্রমিক।

রাজধানী ঢাকার বেশির ভাগ এলাকায় তীব্র গ্যাস সংকটে দিনের বেলায় জ্বলছে না রান্নার চুলা। গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত গ্যাসের সরবরাহ কোনো এলাকায় স্বাভাবিক, আবার কোনো এলাকায় কম চাপে গ্যাস পওয়া যায়। শুধু রান্নার চুলা নয়, গাস সংকট চলছে সিএনজি পাম্পেও। গ্যাসের জন্য পাম্পগুলোতে রাতে দেখা যায় দীর্ঘ লাইন। সিএনজি ভরাতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যাচ্ছে। রাজধানীর অনেক এলাকায় এখন পাইপলাইনের গ্যাসের পাশাপাশি সামর্থ্যবানরা তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন। এতে পরিবারের খরচ বাড়ছে। একদিকে দিতে হচ্ছে গ্যাস বিল অপরদিকে সিলিন্ডার খরচ। এই অবস্থায় ভোগান্তিতে পড়েছেন মহানগরের সব শ্রেণির মানুষ।

রাজধানীর হাট-বাজার, অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমাসহ বিভিন্ন অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা হলেই একে অপরের কাছে প্রথমে জানতে চান, ‘আপনার এলাকায় গ্যাস আছে?’ গ্যাস আছে প্রশ্ন যেন কমন হয়ে গেছে নগরবাসীর মধ্যে। গ্যাস সংকটের কথা জানিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ভুক্তভোগীদের অনেকেই গণমাধ্যম অফিসে ফোন করে ‘গ্যাসের খবর’ জানতে চান। তারা বলছেন, গত সেপ্টেম্বর মাসেও সকাল ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত গ্যাস পাওয়া যেত। এখন পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে গেছে। এলাকাভেদে রাত সাড়ে ১১টা থেকে রাত ২টার মধ্যে আসে। ভোর ৫টার পরই গ্যাসের চাপ কমে যায়। যে চাপ থাকে, তাতে চুলা নিবু নিবু করে জ্বলে, রান্না করা যায় না। অনেক এলাকায় রাতে গ্যাস আসে না তবে চুলার চাবি ঘুরালে শুধু বাতাস আসে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের জরুরি অভিযোগ কেন্দ্রে জমা পড়েছে ভোক্তাদের গ্যাস না পাওয়ার অভিযোগের পাহাড়। তিতাসের কর্মকর্তারা বলছেন, এক মাস ধরেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের চাপ কম বলে তারাও অভিযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু তাদের করার কিছু নেই। চাহিদা অনুযায়ী তারা পর্যাপ্ত গ্যাস পাচ্ছেন না। তাই রেশনিং করে গ্যাস সরবরাহ করছেন। এখন সিএনজি পাম্পে চাহিদা অনুযায়ী অর্ধেক গ্যাসও দেওয়া যাচ্ছে না। আগে যেখানে ৩ থেকে ৫ মিনিটে একটি গাড়িতে গ্যাস ভরা সম্ভব ছিল, চাপ না থাকায় এখন গ্যাস ভরতে ১৫ থেকে ২০ মিনিট লাগছে।

বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন গৃহিণী এবং সাংবাদিক, ডাক্তার, ব্যবসায়ী, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, বেসরকারি চাকুরে এমন ২০ জনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিনিধির। তাদের প্রায় সবাই জানিয়েছেন তারা খাবার-দাবারে খুব কষ্ট করছেন। গৃহিণীরা বলছেন, দিনে গ্যাস থাকে না, গভীর রাতে গ্যাস এলে কতক্ষণ থাকবে তা বোঝার উপায় নেই। কোনোদিন তিন ঘণ্টা কোনো দিন ২ ঘণ্টা পর গ্যাস চলে যায়। আবার কোনো কোনো এলাকায় নিভু নিভু গ্যাস আসে। ফলে রান্না কম করতে হয়। কর্মজীবীরা জানান, তাদের বেশির ভাগই সকালের নাশতা না করেই অফিসমুখী হন। গ্যাসের অভাবে সকালের নাশতা তৈরি হয় না। আবার অনেকের প্রতিদিন হোটেলে নাশতা করার আর্থিক অবস্থাও নেই। ফলে চা-বিস্কুট এবং এটা-সেটা খেয়ে সকাল পাড় করেন। গৃহিণীদের বক্তব্য দ্রব্যমূল্যের এমনিতেই ঊর্ধ্বগতি, চাহিদার তুলনায় পণ্য কম ক্রয় করতে হচ্ছে; এর মধ্যে চুলায় গ্যাস না থাকায় রান্না করা যাচ্ছে না।

অনুসন্ধান করে জানা গেছে, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, মাতুয়াইল, শ্যামপুর, কদমতলী, দোলাইরপাড়, সায়েদাবাদ, মোহাম্মদপুর, পান্থপথ, কাঁঠালবাগান, কলাবাগান, তোপখানা, পল্টন, কমলাপুর, মিরপুর, পুরান ঢাকা, মুগদা, মান্ডা, বাড্ডা থেকে গ্যাস সংকটের বিষয়ে অভিযোগ আসছে বেশি। অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি থেকেও অনেকেই গ্যাস সংকটের বিষয়ে অভিযোগ করেন।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। একসময় সর্বোচ্চ ৩২০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়েছে। এখন দিনে সরবরাহ করা হচ্ছে ২৭৫ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে দিনে ৪৮ কোটি ঘনফুট। দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে দিনে ৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের কথা থাকলেও চাহিদা অনুসারে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। এতে পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ কমে গেছে। গ্রাহকরা নিয়মিত অভিযোগ করছেন। কিন্তু তারা কোনো সমাধান দিতে পারছেন না। দিনে তাদের গ্যাসের চাহিদা ১৮০ থেকে ১৯০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু এখন পাচ্ছেন ১৬০ কোটি ঘনফুটের মতো।

জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার গণমাধ্যমকে বলেছেন, কিছুদিনের মধ্যে গ্যাসের সংকট কেটে যাবে। বাসাবাড়ির পাশাপাশি এখন ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে নীরবচ্ছিন্ন গ্যাস দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। তাই এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে।

জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. এম শামসুল আলম বলেন, সংকট দূর করতে চাইলে আগে অপচয়, অনিয়ম বন্ধ করতে হবে। অভ্যন্তরীণ গ্যাস উত্তোলন ও উদ্ভাবনে গুরুত্ব দিতে হবে। ঋণ করে জ্বালানি কেনা কোনো সমাধান নয়। এই ঋণ সুদসহ পরিশোধ করতে হবে। এই ঋণ ও সুদ কোনো না কোনোভাবে জনসাধারণের ওপরই চাপবে।

এদিকে গ্যাস সংকটে দেশের শিল্প কারখানায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ক্রমান্বয়ে গ্যাস সংকট আরো বাড়ছে। এতে করে সংকটে পড়ছে শিল্প-কারখানাও। কমেছে উৎপাদন, বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়। শ্রমিকদের বসিয়ে রেখে বেতন দিতে হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে পোশাক রফতানিকারকরা বিদেশে বাজার হারানোর আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ স্টিল মেনুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মাসাদুল আলম মাসুদ বলেন, গ্যাসের প্রেসার দিনে থাকে না। রাতে কিছুটা পাওয়া যায়। আর এখন লোডশেডিং বেড়ে গেছে, দিনে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা হয়। এতে উৎপাদন নেমে এসেছে অর্ধেকের নিচে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে সরবরাহ চেইনে বিঘœ ঘটবে। আমাদের কাছ থেকে মাল নিয়ে যারা সাইট চালান (নির্মাণ কাজ) সেগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে।

Image Not Found!
Image Not Found!
Image Not Found!
Image Not Found!
Image Not Found!