সর্বশেষ সংবাদ
নির্বাচনকে সামনে রেখে সংসদে উত্থাপিত প্রস্তাবিত ‘আনসার ব্যাটালিয়ন বিল-২০২৩’ নিয়ে পুলিশ বাহিনীতে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ের এসপি, অতিরিক্ত এসপি, এ এসপি, ইন্সপেক্টর, এসআই ও এ এস আই পদে কর্মরতদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। তাদের আশঙ্কা পুলিশ বাহিনীর মতো আনসার বাহিনীকে তল্লাসী ও গ্রেফতারের ক্ষমতা দিলে আইন শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব পালনে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। ২০১৭ সালেও পুলিশ বাহিনীর প্যারালাল আনসার বাহিনীকে অধিক ক্ষমতা দেয়ার একই চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন পুলিশের তীব্র আপত্তির কারণে তা স্থগিত করা হয়। এবারও তা বাতিলের দাবি জানিয়েছে পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ পুলিশ এসোসিয়েশন। এ নিয়ে গত চার দিনে ৬টির অধিক বৈঠক হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দফর এবং নীতি নির্ধারনি পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে। গতকাল বুধবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক সভায়ও এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এতে পুলিশ বাহিনীর প্রধান ছাড়াও পুলিশের প্রায় সকল ইউনিট প্রধানরা অংশ গ্রহণ করেন এবং প্রস্তাবিত আনসার ব্যাটালিয়ন আইনটি পুরোপুরি বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
পুলিশের মতো আনছার বাহিনীকে ক্ষমতা দেয়ার বিরোধিতা করে জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেছেন, আনসার বাহিনীকে অধিক ক্ষমতা দিয়ে সরকার রক্ষী বাহিনী›র পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চায়। বিরোধী দলের প্রতি ত্রাস, ভীতি ও শঙ্কা ছড়ানোর উদ্দেশ্যে সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের এমপি বলেছেন, নির্বাচনের আগে হঠাৎ আনসারদের পুলিশি ক্ষমতা দেওয়ার চেষ্টা অস্বাভাবিক ব্যাপার। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আনসার বাহিনীকে পুলিশি ক্ষমতা দেওয়া দুরভিসন্ধিমূলক। এমনকি বছরের পর বছর ধরে পুলিশী নির্যাতনের শিকার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আনসার সদস্যদের পুলিশের মতো গ্রেফতার ও তল্লাশির ক্ষমতা দেওয়ার পরিকল্পনা ‘ভয়াবহ দুশ্চিন্তার ও আতঙ্কের বিষয়। সারা পৃথিবীতে পুলিশকেই প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। এখানে আপনার আনসারকে ক্ষমতা দেয়া হবে, যাদের সেসিক ট্রেইনিংগুলো পর্যন্ত নেই। বিএনপি নেতার দৃষ্টিতে আনসার বাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের চিন্তা থেকেই সরকারের এই উদ্যোগ নিয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির সামনে আমলযোগ্য অপরাধ করলে তাকে বিনা পরোয়ানায় আটক করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সুতারাং নতুন করে আটক করার ক্ষমতা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই। প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী আনসার ব্যাটালিয়নকে জব্দ তালিকা প্রস্তুত, তল্লাশি ও স্থাপনায় প্রবেশ করার ক্ষমতা দেয়া হলে আইনি জটিলতা তৈরি হবে।
‘আনসার ব্যাটালিয়ন বিল-২০২৩’ বিল তথা আনসার বাহিনীকে পুলিশি ক্ষমতা দেয়া নিয়ে যখন তোলপাড় চলছে; তখন গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আনসার বাহিনীকে গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া হয়নি। এটা একটা মিস ইনফরমেশন, আপনাদের ভুল ধারণা। এই প্রশ্নটা ভুল ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে করছেন। আনসার বাহিনীকে গ্রেফতার করার পারমিশন কখনো দেয়া হয় না, আজকেও দেয়া হয়নি এবং কোনো আইন দ্বারা সেটা দেয়ার কোনো ক্ষমতা আমাদের নেই। তিনি বলেন, আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধির আওতার ভেতরে থেকে সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কাজ করতে হবে। এটা হলো মূল কথা। তাদের যে আইনটি আসছে, সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ পর্যায়ে এখানে এসেছে। এটা আমাদের স্থায়ী কমিটিতে গেছে, স্থায়ী কমিটির সদস্যরা এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন। সেখানো কোনো শব্দ, বাক্য যদি এ ধরনের প্রশ্নের অবতারণা করে তবে সেগুলো কারেকশন হবে। এখানে প্রচলিত আইনের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কোনো বাক্য যদি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে সেটি তারা পরিশুদ্ধ করবেন। যেকোনো বাহিনীকে প্রচলিত ফৌজদারি আইন মেনে কাজ করতে হয়। তিনি আরো বলেন, স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি এখানে ভুল বোঝাবুঝির কোনো অবকাশ নেই। এখানে আমি শুনতে পাচ্ছি অনেক জায়গায় প্রচারিত হচ্ছে এবং বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে আনসার পুলিশের ক্ষমতা নিয়ে যাচ্ছে-এগুলো প্রপাগান্ডা, সব মিস ইনফরমেশন। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমরা সবসময় বলি আমাদের দুটো ফোর্সই আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য।
পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, আনসার গঠন করা হয়েছিল পুলিশকে সহায়তা করতে। নির্বাচন, আগামী ২৮ অক্টোবরের মতো উত্তেজনাপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচিসহ বড় বড় ঘটনায় সহায়তা দিয়ে আসছে আনসার বাহিনী। এই বাহিনীকে আইজিপির অধীনে দেয়া যেতে পারে। যেমন বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রেষণে র্যাবে গেলেও, র্যাব কিন্তু আইজিপির অধীনে। পুলিশ হলো অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশকে সহায়তা করে র্যাব। একই ধরনের ক্ষমতা আনসারকে দেয়া হলে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী বাহিনী পুলিশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।
পুলিশ কর্মকর্তারা আরো বলেন, এই আইন পাস হলে পুলিশ ও আনসার বাহিনীর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হবে। ওই বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর কাছে পুলিশ কর্মকর্তারা প্রস্তাবিত আইনটির কয়েকটি ধারা নিয়ে আপত্তি জানান। বিশেষ করে আনসারকে ফৌজদারি অপরাধ তদন্তের ও গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া সংক্রান্ত ধারা নিয়ে।
সাবেক আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, পুলিশের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। অন্য একজনকে দেয়া উচিত হবে না। এতে পুলিশ বাহিনীর মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখা দেবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের আপত্তির কারণে প্রস্তাবিত আইনে অপরাধীকে আটক, দেহ তল্লাশি ও মালামাল জব্দের ক্ষমতা দেওয়ার কথা সরাসরি রাখা না–ও হতে পারে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির সামনে আমলযোগ্য অপরাধ সংঘটিত হলে তিনি অপরাধীকে বিনা পরোয়ানায় আটক করতে পারেন। এই ধারা অনুযায়ী আনসারকে ক্ষমতা দেওয়া হতে পারে।
বাংলাদেশ পুলিশ এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইন্সপেক্টর মাজহারুল ইসলাম বলেন, প্রস্তাবিত আনসার আইনটি সংবিধান ও ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের সাংঘর্ষিক। তাই এই আইন পাশ করা উচিত হবে না। এতে পুলিশের মতো একটি প্রতিষ্ঠিত বাহিনীর মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেবে। আমরাও চাই আনসার বাহিনীর উন্নত হোক। কিন্তু সংবিধান ও ফৌজদারি কার্যবিধির সাংঘর্ষিক কোন কিছু যেন না করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘আনসার ব্যাটালিয়ন বিল, ২০২৩’ গত সোমবার জাতীয় সংসদে তোলা হয়। এরপর তা তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। বিলটি সংসদে তোলার আগে গত রোববার আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের নেতৃত্বে ঊর্ধ্বতন ২৫ জন কর্মকর্তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে দেখা করে তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছিলেন। এ সময় পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ও পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। গত রোববারের বৈঠকের পর গত মঙ্গলবার পুলিশ ও আনসারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকটি প্রায় পৌনে চার ঘণ্টা ধরে চলে। শুরু হয়েছিল বেলা তিনটায়। সূত্র বলছে, বৈঠকে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বৃহস্পতিবার সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিলটির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। সরকার সংসদের বর্তমান অধিবেশনেই আইনটি পাস করাতে চায়।
কী আছে প্রস্তাবিত আইনে: আনসার ব্যাটালিয়ন আইন, ২০২৩ এর খসড়ার ৮ নম্বর ধারায় ব্যাটালিয়ন সদস্যের এখতিয়ার ও ক্ষমতা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত আইনের ৭ নম্বর ধারার ‘কার্যাবলি সম্পাদনকালে, কোনো ব্যাটালিয়ন সদস্য তাহার সম্মুখে সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমোদনক্রমে অপরাধ সংঘটনকারীকে আটক করিয়া অবিলম্বে পুলিশের নিকট সোপর্দ করিবে এবং ক্ষেত্রমত, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট অথবা এতদুদ্দেশ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নির্দেশক্রমে উক্ত আটক ব্যক্তির দেহ তল্লাশি, কোনো স্থানে প্রবেশ ও তল্লাশি এবং মালামাল জব্দ করিতে পারিবে।
কার্যাবলি কী কী, তা উল্লেখ করা হয়েছে ৭ নম্বর ধারায়। কাজগুলো হলো সরকারের নির্দেশে জননিরাপত্তামূলক কাজ, দুর্যোগ মোকাবিলা, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নিরাপত্তা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নিরাপত্তা, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় সহায়তা, সরকারি সম্পত্তি ও জনস্বার্থে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের চাহিদা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন, সশস্ত্র বাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও পুলিশকে সহায়তা দেয়া এবং সরকার অর্পিত অন্য যেকোনো দায়িত্ব পালন। বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীতে তিন ধরনের সদস্য রয়েছেন ব্যাটালিয়ন আনসার, আনসার বাহিনী ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী। ব্যাটালিয়ন আনসার পরিচালিত হয় ১৯৯৫ সালের আইন দ্বারা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর (ভিডিপি) সদর দপ্তর থেকে একটি প্রস্তাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তাতে আইন সংশোধন করে ব্যাটালিয়ন আনসারের ক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলা হয়। তবে পুলিশের আপত্তির কারণে প্রস্তাবটি এত দিন আটকে ছিল।